ক্যামেরা আবিস্কার এবং এর বিবর্তনের ইতিহাস

ক্যামেরা আবিস্কার এবং এর বিবর্তনের ইতিহাস


ক্লিক! ক্যামেরার এই ক্লিক শব্দটি এখন আমরা প্রায় প্রতিদিনই শুনি, তাই না? কিন্তু ক্যামেরার যাত্রাটা এতটাও সহজ ছিলো না। ক্যামেরার ইতিহাসে রয়েছে দারুণ কিছু গল্প এবং দূরদর্শী চিন্তা শক্তির কিছু মানুষ। জানতে চান সেই সব ইতিহাস? তাহলে প্রস্তুত হন, সময়ের এই যাত্রায় আমরা আপনাদের জানাবো ক্যামেরা এবং এর আবিষ্কারকদের অসাধারণ সব ইতিহাস।

ইতিহাসের প্রথম ক্যামেরা:

ক্যামেরার ইতিহাস শুরু হয় 'ক্যামেরা অবস্কুরা' থেকে। 'ক্যামেরা অবস্কুরা' একটি ল্যাটিন শব্দ, যার বাংলা আভিধানিক অর্থ হলো 'অন্ধকার কক্ষ বা ঘর'। এই পদ্ধতিতে মূলত, একটি অন্ধকার কক্ষের এক পাশের দেওয়ালে একটি ছিদ্র করে দেওয়া হতো, সেই ছিদ্রের মধ্য দিয়ে বাহিরের আলো প্রবেশ করে, এবং এর ফলে, বিপরীতে পাশের দেওয়ালে বাহিরের কোনো একটি দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। এই প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হওয়া ছবিটি উল্টো দেখা যেতো, অনেকটা মিরোর ইফেক্টের মতো। ক্যামেরা অবস্কুরা প্রথমবারের মতো আবিষ্কৃত হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকের দিকে।

ইবনে আল-হাইথামের আলোকবিজ্ঞান তত্ত্ব:

১১শ শতকে আরবের গনিতবীদ 'ইবনে আল হাইথাম' (আলহাজেন) প্রথমবারের মতো এর সঠিক ব্যাখা প্রদান করেন। যে কিভাবে আলো সোজা পথে ভ্রমণ করে এবং কিভাবে ছোট ছিদ্র দিয়ে ছবি প্রজেক্ট করা যায়। পরবর্তী ১৫শ শতকে চিত্র শিল্পীরা, ছবি আকার কাজে একটি টুল হিসেবে 'ক্যামেরা অবস্কুরা' এর ব্যবহার শুরু করেন। 'লিওনার্দো দা ভিন্চি' এই পদ্ধতি ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে প্রাকৃতিক দৃশ্য গুলো অঙ্কন করতেন। মূলতো এখান থেকেই ক্যামেরা তৈরির যাত্রা শুরু হয়।

বিশ্বের প্রথম ছবি:

১৮শ শতক অব্দি ক্যামেরা অবস্কুরা আকার অনেকটাই ছোট করে আনা হয়। ১৮২৬ সালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে সিলভার নাইট্রেট এর মতো কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে, যা আলোর সংস্পর্শে এলে কালো হয়ে যায়। 
তখন 'জোসেফ নিসেফোর নিপস' সাদা কাগজে সিলভার নাইট্রেট এর প্রলেপ লাগিয়ে, একটি ক্যামেরা অবস্কুরার মধ্যে রেখে প্রথম বারের মতো অটোমেটিক ছবি তুলতে সক্ষম হন। যেটি আধুনিক ক্যামেরার ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। তবে এই প্রকৃয়ায় একটি ছবি তুলতে প্রায় ৮ ঘন্টা সময় লাগতো, এবং সিলভার নাইট্রেট এর কাগজটি ক্যামেরা অবস্কুরা থেকে বের করা হলে, তা ধিরে ধিরে নষ্ট হয়ে যেতো।

ড্যাগুয়েরোটাইপ:

আধুনিক ফটোগ্রাফিতে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসেন ফরাসি শিল্পী 'লুই ডাগুয়ের'। তিনি তার পার্টনার তথা 'নিসেফোর নিপস' এর সহযোগিতায় প্রথম এমন একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যার সাহায্যে স্থায়ী ভাবে ছবি তৈরি করা সম্ভব ছিলো। ১৮৩৯ সালে আবিষ্কৃত হয় 'ড্যাগুয়েরোটাইপ'। এটি ছিল বানিজ্যিকভাবে রপ্তানিকৃত প্রথম ক্যামেরা বা ছবি তোলার পদ্ধতি।

কোডাক ক্যামেরা এবং রোল ফিল্ম:

ক্যামেরার ইতিহাসের সব থেকে বড় বিপ্লব নিয়ে আসেন জর্জ ইস্টম্যান। তিনি প্রথম 'রোল ফিল্ম' উদ্ভাবন করেন এবং ১৮৮৮ সালে কোডাক ক্যামেরা বাজারে আনেন। এটি একটি বাক্স ক্যামেরা ছিলো যা ১০০টি ছবি ধারণ করতে পারতো। সেই সময় কোডাকের প্রচারণার প্রধান স্লোগান ছিলো "আপনি শুধু বোতাম চাপুন, বাকিটা আমরা করবো"। এরই মাধ্যমে প্রথমবারের মতো, ফটোগ্রাফি পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষের হাতে।

ডিজিটাল ক্যামেরার আবিষ্কার:

রাসায়নিক পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে ডিজিটাল যুগের সূচনা করে 'স্টিভেন স্যাসন'। তিনি ১৯৭৫ সালে প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা আবিষ্কার করেন। তার তৈরি করা ক্যামেরা 'চার্জ-কাপলড ডিভাইস (CCD)' ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে ছবি ধারণ করতো। এটি ফটোগ্রাফির নতুন যুগের সূচনা করে, এবং আধুনিক ক্যামেরার ভিত্তি স্থাপন করে দেয়।

ডিএসএলআর ক্যামেরা:

২০০০ সালে ক্যানন EOS D30 নামে প্রথম কমার্শিয়াল ডিএসএলআর ক্যামেরা প্রকাশ করে, যা খুব দ্রুতই ফটোগ্রাফারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ডিএসএলআর ক্যামেরার বিশেষত্ব হলো এর অপটিক্যাল ভিউফাইন্ডার, যার মাধ্যমে ফটোগ্রাফার সরাসরি লেন্সের মাধ্যমে দেখতে পারেন এবং এর লেন্স পরিবর্তনের সুবিধা। ডিএসএলআর ক্যামেরাগুলির মাধ্যমে ফটোগ্রাফির জগতে একটি বিপ্লব ঘটে। এই ক্যামেরাগুলি উচ্চ মানের ছবি তোলার ক্ষমতা এবং ডিটেইলযুক্ত ছবি ধারণ করতে পারায় পেশাদার ও অপেশাদার উভয়ের জন্যই অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

মিররলেস ক্যামেরা:

ক্যামেরা প্রযুক্তিতে একটি বড় পরিবর্তন আসে মিররলেস ক্যামেরার মাধ্যমে। Panasonic এবং Olympus যৌথভাবে ২০০৮ সালে প্রথম মাইক্রো ফোর থার্ডস মিররলেস ক্যামেরা বাজারে নিয়ে আসে। মিররলেস ক্যামেরা ডিএসএলআর ক্যামেরার মতোই উন্নত ছবি তোলার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু এতে কোনো আয়না ব্যবস্থার প্রয়োজন হয় না। এর ফলে ক্যামেরাগুলি আরও হালকা ও ছোট হয়ে থাকে, যা ফটোগ্রাফারদের কাছে ক্যামেরা গুলিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।

উপসংহার:

ক্যামেরার ইতিহাস এক অসাধারণ ও উদ্ভাবনী যাত্রা, যা প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিস্তৃত। 'ক্যামেরা অবস্কুরা' থেকে শুরু করে মিররলেস ক্যামেরা পর্যন্ত, প্রযুক্তিগত প্রতিটি ধাপ মানুষের ছবি তোলার ক্ষমতাকে আরও সহজ ও উন্নত করেছে। ক্যামেরা অবস্কুরার মাধ্যমে প্রথমবারের মতো ছবি প্রজেক্ট করার ধারণা আসে, যা আলোকচিত্রের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করে দেয়। ১৮২৬ সালে নিসেফোর নিপস প্রথম সফলভাবে একটি স্থায়ী ছবি তোলেন, কিন্তু এটি ছিল বেশ সময়সাপেক্ষ। এরপর লুই ডাগুয়ের এর ড্যাগুয়েরোটাইপ পদ্ধতি, ফটোগ্রাফিকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়। জর্জ ইস্টম্যানের কোডাক ক্যামেরা এবং রোল ফিল্মের আবিষ্কার সাধারণ মানুষের হাতে ফটোগ্রাফিকে তুলে দেয়, যেখানে শুধু একটি বোতাম চাপলেই ছবি তোলা যেত। পরে, ডিজিটাল যুগের সূচনা করেন স্টিভেন স্যাসন। ১৯৭৫ সালে, তিনি রাসায়নিক পদ্ধতির পরিবর্তে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। ডিএসএলআর ক্যামেরা এবং মিররলেস ক্যামেরার আবিষ্কার আরও উন্নত এবং হালকা প্রযুক্তির দিকে ফটোগ্রাফির যাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, যা ফটোগ্রাফারদের জন্য অভাবনীয় সুবিধা সৃষ্টি করে।
ক্যামেরার এই দীর্ঘ যাত্রা আমাদের ছবি তোলার প্রক্রিয়াকে আরও নিখুঁত করেছে এবং আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলো সংরক্ষণকে আরও সহজ করেছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post